পিআর পদ্ধতির পক্ষে দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ: সুজনের জরিপ

এবার নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজন’ প্রস্তাবিত জাতীয় সনদ চূড়ান্তকরণে জনমত যাচাইয়ের একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। মঙ্গলবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই জরিপের ফল তুলে ধরা হয়। সুজন জানায়, ২০১৩ সালে একটি খসড়া জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা হয় রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে, যার ভিত্তিতে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সম্প্রতি সনদ চূড়ান্ত করার আগে জনমত যাচাই করা হয়েছে। মে থেকে জুন মাসে পরিচালিত ৪০টি প্রশ্নভিত্তিক এই জরিপে অংশ নেন মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন, যাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৩ জন পুরুষ, ৩৩৫ জন নারী এবং ৫ জন তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক।

এদিকে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৯ শতাংশ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) গঠনের পক্ষে মত দেন। উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনে তারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির (পিআর) পক্ষে মত দেন ৭১ শতাংশ। একই ব্যক্তির পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া উচিত বলে মনে করেন ৮৯ শতাংশ। এছাড়া, নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে নিম্নকক্ষে ১০০টি সংরক্ষিত আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দেন ৬৩ শতাংশ, আর বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগে সম্মতি দেন ৮৬ শতাংশ। সিনেটেও নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের বিষয়ে ৬৯ শতাংশ এবং বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগে ৮২ শতাংশ মত দেয়। একই ব্যক্তি যেন একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলপ্রধান না হন, এই বিধানের পক্ষে মত দেন ৮৭ শতাংশ মানুষ।

শাসন কাঠামো নিয়ে মতামত তুলে ধরতে গিয়ে সুজন জানায়, ৮৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজ গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন ৮৬ শতাংশ এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কিছুটা বাড়ানো উচিত মনে করেন ৮৮ শতাংশ। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের পক্ষে মত দেন ৮৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সম্প্রীতির অন্তর্ভুক্তির পক্ষে মত দেন ৯০ শতাংশ।

মৌলিক অধিকার বিষয়ে জরিপে অংশ নেওয়া ৮৮ শতাংশ মানুষ এর পরিধি বৃদ্ধির পক্ষে, ৮৪ শতাংশ শর্তহীন মৌলিক অধিকার চায় এবং ৮০ শতাংশ একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ, এমনকি সেনাবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ দিতে চান। দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন ও স্থানীয় সরকার কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করার পক্ষে রয়েছেন ৯০ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুনর্বহালের পক্ষে মত দিয়েছেন ৮৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।

নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারেও বিস্তৃত মতামত উঠে আসে জরিপে। অংশগ্রহণকারীদের ৮৭ শতাংশ মনে করেন, নির্বাচনী সময়ে নির্বাহী বিভাগের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নেওয়া উচিত। স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষের পক্ষে মত দেন ৮৪ শতাংশ এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও সুষ্ঠুতা সম্পর্কে কমিশনের পক্ষ থেকে গণবিজ্ঞপ্তি জারির পক্ষে থাকেন ৮৬ শতাংশ মানুষ। নির্বাচনী ব্যয় নিরীক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন ৮৮ শতাংশ এবং অপরাধী, দুর্নীতিবাজ বা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলের সদস্য না করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন ৯২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। পূর্ববর্তী নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তের দাবি জানান ৭৯ শতাংশ এবং প্রবাসী ভোটারদের নিবন্ধনের পক্ষে মত দেন ৮৭ শতাংশ মানুষ। ‘না ভোট’ ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে সমর্থন করেন ৮৩ শতাংশ এবং জাতীয় ডেটা নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাবের পক্ষে মত দেন ৮৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।

রাজনৈতিক দল ও দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া সংস্কারের প্রশ্নে পাঁচ বছর পরপর নিবন্ধন নবায়নকে সমর্থন করেন ৭৬ শতাংশ, দলের আর্থিক লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে করা ও অডিট হিসাব প্রকাশের পক্ষে রয়েছেন ৯১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। গোপন ভোটের মাধ্যমে মনোনয়ন প্রার্থী নির্বাচনের পক্ষে মত দেন ৮৩ শতাংশ। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে ৮৫ শতাংশ, লেজুড়বৃত্তিক ও প্রবাসী শাখাহীন দল চায় ৮০ শতাংশ এবং স্বাধীন পুলিশ কমিশনের পক্ষে মত দেন ৯০ শতাংশ মানুষ।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ ও কার্যকারিতা নিয়েও জরিপে মতামত উঠে আসে। বিভাগীয় শহরগুলোতে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন চান ৮৮ শতাংশ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পক্ষে আছেন ৮৪ শতাংশ এবং উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনের পক্ষে ৮১ শতাংশ। স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রবর্তনের পক্ষে মত দেন ৮৫ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের পক্ষে মত দেন ৯০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সদস্য জিল্লুর রহমান। এতে বক্তব্য দেন জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সদস্য ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। জরিপের ফল উপস্থাপন করেন সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য মো. একরাম হোসেন।