টার্গেট অসমীয়া মুসলিম ও বাংলাদেশ! সীমান্তঘেঁষা আদিবাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে ভারত

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় ঘোষণা দিয়ে আদিবাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে রাজ্যটির সরকার। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে। এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই আদিবাসীরা অস্ত্রের জন্য আবেদন করতে পারবেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মূলত বিপদাপন্ন অঞ্চল, শত্রুলবলিত অঞ্চল, ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে এই অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে মুসলিম ও বাংলাদেশ-বিরোধী উগ্রবাদীদের হাতে। এই ঘোষণায় রাজ্যটির মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সীমান্তের এপারে বাংলাদেশেও। কারণ এই অস্ত্র সীমান্তবর্তী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হতে পারে।

বর্তমানে রাজ্যটি শাসন করছেন ভারতের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা। নতুন আইনের আওতায় বারপেটা, ধুবড়ি, জানিয়া, ধিং, মরিগাঁও, নয়গাঁও, রূপহী প্রভৃতি জেলার আদিবাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। এসব অঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলিমের সংখ্যাই বেশি, প্রায় ৭০ শতাংশ।

গত বুধবার (৬ আগস্ট) আসামের কট্টর হিন্দুত্ববাদী মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ঘোষণা দেন। দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে একটি ওয়েবসাইট চালুর ঘোষণা দেন। এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে রাজ্যের যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজেদের জীবনের জন্য হুমকি অনুভব করছেন এবং সংবেদনশীল এলাকায় বসবাস করছেন, তারা অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিশ্বশর্মার এই ঘোষণার ফলে ২০ লাখ অসমীয় মুসলিমের জীবন চরম হুমকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি এপারের বাংলাদেশী সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর বাসিন্দাদের জীবনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অঘোষিতভাবে আসামের আশ্রমে-স্কুলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছে বহুবছর আগ থেকেই। এবার দেওয়া হলো প্রকাশ্য ঘোষণা! দিনে থাকে স্কুল-মন্দির, রাতে হয় ফায়ার গ্রাউন্ড। নতুন আইনের আওতায় আসা বারপেটা, ধুবড়ি, জানিয়া, ধিং, মরিগাঁও, নয়গাঁও, রূপহী প্রভৃতি জেলায় বাংলাভাষী মুসলিমই বেশি। ২০১৯ সালের বিতর্কিত এনআরসি নীতির মারপ্যাঁচে তাদের প্রায় সবাই নাগরিকত্বহীন। আসামের এই নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া মুসলিম ও বাংলাদেশকে টার্গেট করেই এই অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ‘দুর্গা ব্রিগেড’ নামে মহিলাদের জন্যও একটি অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে মহিলারা। যদিও ভিডিওটির তাৎক্ষণিকভাবে সত্যতা যাজাই করা সম্ভব হয়নি।

এর আগে হিমন্ত বিশ্বশর্মা সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘অসমীয়া ভাষাভাষী জনগণ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে এমনকি নিজেদের গ্রামেও হামলার হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন।’

ভারতে সাধারণত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু রাজ্যজুড়ে হঠাৎ করে সবার জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স উন্মুক্ত করে দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার এ উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করছেন বিরোধীদলীয় নেতারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে রাজ্যের বিরোধী দল কংগ্রেসের আইনপ্রণেতা গৌরব গগৈ বলেন, রাজ্য সরকারের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার এ উদ্যোগে গ্যাং সহিংসতা ও ব্যক্তিগত প্রতিশোধমূলক অপরাধ বৃদ্ধি পাবে। এটি সুশাসন নয় বরং আইনহীনতার দিকে এক বিপজ্জনক পশ্চাৎগামী পদক্ষেপ।

গতকাল শনিবার আসামের একটি মহিলা সংগঠন রাজ্য সরকারের কাছে ‘সংবেদনশীল এলাকায় আদিবাসীদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্রের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এই উদ্যোগ অস্ত্রের বিস্তার এবং এমনকি রাজ্যকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিবে।

অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘নারী নাগরিক মঞ্চ’-এর একটি সভায় আদিবাসীদের অস্ত্র লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি এবং সমাজের উপর এর প্রভাব এবং পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নমনীয়’ নীতির মাধ্যমে বেসামরিক নাগরিকদের ‘অস্ত্রীকরণ’ করার পরিবর্তে যেকোনো হুমকি মোকাবেলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং কর্মীদের শক্তিশালী করার দিকে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিকীকরণ এবং মেরুকরণের কোনও সুযোগ নেই উল্লেখ করে আরও বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত রাজ্যে বন্দুক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেবে। সবাই ধরে নেবে, দশকের পর দশক ধরে জঙ্গিবাদ প্রত্যক্ষ করার পর রাষ্ট্র অস্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। এতে আরও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ‘গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, লিঙ্গ সহিংসতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং অস্ত্র বিস্তার ঘটাবে।’’

সভায় দেশটির প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্যান্যদের কাছে সরকারের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে একটি স্মারকলিপি জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের শুরু করার এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আসামের মন্ত্রিসভা গত ২৮ মে সিদ্ধান্ত নেয়, সরকার “অরক্ষিত এবং প্রত্যন্ত” অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি জাগানোর জন্য অস্ত্র লাইসেন্স দেবে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে তখন বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ধুবড়ি, মরিগাঁও, বরপেটা, নগাঁও এবং দক্ষিণ সালমারা-মানকাচর জেলা এবং রূপাহি, ধিং এবং জানিয়ার মতো এলাকাগুলিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি দাবি করেন, ১৯৭৯-৮৫ সালের মধ্যে অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অসম আন্দোলনের সময় থেকেই এই অঞ্চলের আদিবাসীরা নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্র লাইসেন্সের দাবি করে আসছে।

এরআগে ২৫ মে বাংলাদেশের ‘দুই চিকেনস নেকে’ আক্রমণের হুমকি দেয় আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ভারতের একটি চিকেনস নেক থাকলেও বাংলাদেশের আছে দুটি। বাংলাদেশ যদি ভারতের চিকেনস নেকে আক্রমণ করে, তাহলে ভারতও বাংলাদেশের দুই চিকেনস নেকে আক্রমণ করবে।

উল্লেখ্য, আসাম রাজ্য ভারতের ৪,০৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্যে ২৬২ কিলোমিটার ঘেঁষে আছে। রাজ্যটি বর্তমানে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সম্প্রদায় চরম দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। ২০২১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে হিমন্ত শর্মার নেতৃত্বে সরকার অন্তত ৫০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করেছে, যাদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম। শুধু গত এক মাসেই রাজ্যজুড়ে পাঁচটি অভিযানে ৩ হাজার ৪০০টি মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে।ঘরবাড়ি ধ্বংসের পাশাপাশি নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন, এমনকি জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে।