ঢাকা থেকে গাজার পথে শহিদুল আলমের দিনলিপি

খ্যাতিমান বাংলাদেশি আলোকচিত্রী ও অধিকারকর্মী ড. শহিদুল আলম গাজামুখী নৌবহরে যোগ দিয়েছেন। ভূমধ্যসাগরে গাজা উপকূলীয় রেড জোনে কনশানস নৌযান থেকে সকল সহযাত্রীসহ ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ফেসবুকে নানা পোস্ট দিচ্ছিলেন। সেসব পোস্টের নির্বাচিত অংশ নিয়ে সমকালের বিশেষ আয়োজন।

আর কিছুক্ষণের মধ্যে রোমে নামব। সেখান থেকে ওতরান্তো পর্যন্ত ৬০০ কিমি রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, যেখানে ফ্লোটিলা অপেক্ষা করছে। ইতোমধ্যে ১০টি ছোট নৌকা গাজার উদ্দেশে রওনা হয়েছে। আমরা সকল বাধা মাড়িয়ে পৌঁছাব। বিশ্বজুড়ে যারা শুভেচ্ছা ও প্রার্থনা পাঠিয়েছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমি সেসব শুভকামনা নিয়ে আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের কাছে যাচ্ছি। ফিলিস্তিন মুক্ত হবেই!

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাত
ওতরান্তো এসে কষ্ট করে একটা তাঁবু জোগাড় করতে পেরেছি। আগামীকাল দুপুরে গাজার উদ্দেশে যাত্রা। কিছুটা দূরে একটা বেঞ্চে বসে ওয়াইফাই পাওয়া যায়! এখন একটু খাবার খেতে হবে।

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ভোর
আমার যাত্রা আসলে শুরু হয়েছিল ২৫ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক থেকে। ‘সবার জন্য, সর্বত্র মানবাধিকার’ শীর্ষক একটি সেশনে অংশ নিয়েছিলাম। ফোর্ড ফাউন্ডেশনে এই সেমিনারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, ভলকার তুর্কসহ আরও অনেকে বক্তব্য রাখছিলেন। এরপর জাতিসংঘ ভবনে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সেশনগুলোতে বুড়ি ছুঁয়ে ছুটে যাই রুচিরা গুপ্তার কাছে। সেখানে স্টিফেন মায়েস আমাদের মিডিয়া লাইব্রেরির জন্য যে বইগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলো গুছিয়ে রওনা হই। ২৭ তারিখ ঢাকায় এসে একগুচ্ছ বৈঠকে অংশ নিই। এরপর ২৮ তারিখ সকালে রোমের উদ্দেশে যাত্রা।

দুপুর
ফ্লোটিলায় ওঠার আগে প্রেস কনফারেন্সে যাওয়ার পথে আমার তাঁবু থেকে বেরিয়ে একগুচ্ছ অপরাজিতা ফুল চোখে পড়ল। আমার মা এই ফুল খুব ভালোবাসতেন। বাংলাদেশে অপরাজিতা নামে পরিচিত এই ফুল ইন্দোনেশিয়ার টারনেট দ্বীপে উদ্ভূত উদ্ভিদ প্রজাতি।

বিকেল
ইতালির ওতরান্তো শহরে একজন ট্রমা ও অর্থোপেডিক চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা। তিনি বলছিলেন, গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। গতকাল শিফা হাসপাতালের ওপর হামলা হয়েছে, যা ছিল গাজার শেষ চালু হাসপাতাল। এ চিকিৎসকও কনশানস জাহাজের যাত্রীদের একজন।

রাত
আমরা কনশানস জাহাজে যাত্রা শুরু করেছি, বিশ্বনেতাদের বিবেক জাগাতে, যারা এই গণহত্যায় নীরব সহযোগী। মিঠাপানি এই জাহাজে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এটা শুধু বিপুল পরিমাণে মজুত করাই যথেষ্ট নয়; বরং এমনভাবে ব্যবহার করতে হয়, যাতে স্থলভাগে থাকলে কেউ মেনে নিত না।

১ অক্টোবর ২০২৫, রাত
আমরা বহরের পেছনে থাকলেও সামনে থাকা নৌকাগুলোর ওপর ইসরায়েলের হামলার খবর আসছে, যদিও তারা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল। আলমা জাহাজ থেকেও খবর এসেছে, সেখানকার সিসি ক্যামেরাগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে কনশানসে আমরা সবাই মিলে নিচতলায় ডেকে এসেছি; সংহতি-সংগীতের মধ্যে শক্তি খুঁজছি।

ভোর
আকাশভরা তারা। শেষবার এত তারা দেখেছিলাম ১৯৮৫ সালে নেপালের ফেরিচ থেকে এভারেস্ট বেজক্যাম্পে যাওয়ার সময়। বরফগুলো তারার আলোয় ঝলমল করছিল। তারা হয়তো উজ্জ্বল, কিন্তু পৃথিবীতে এখনও অন্ধকার। শয়তানরা পৃথিবীতেই জাহান্নাম বানাতে চায়। কিন্তু আমরা সব বন্ধন মুক্ত করব। প্যালেস্টাইন মুক্ত হবেই!

২ অক্টোবর ২০২৫, রাত
সমুদ্র ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ চমক ও ঝড়ের বিপরীতে আমরা টিকে থাকার সংগ্রাম করছি। আজ আমরা খবর পেয়েছি, ইসরায়েলি জলদস্যুরা নৌযান আলমাকে ধরার চেষ্টা করছে। আমাদের জাহাজ সবচাইতে বড়। তারা আলমায় হামলা করে আমাদেরও ভয় দেখাতে চায়। আমরা এতে বিচলিত নই; সবাই এই ঝড়ের রাতে একটি বার্তা দেওয়ার জন্য এবং তাদের প্রতি সংহতি-সংগীত গাওয়ার জন্য একত্রিত হয়েছি। আমরা জানি, আপনারাও আমাদের পাশে আছেন। জেগে উঠুন, প্রতিরোধ করুন। আমরা ন্যায়ের লড়াই থামাব না।

৩ অক্টোবর ২০২৫
আমরা এখন ফিলিস্তিন টাইমজোনে। আজ সকালে সমুদ্র শান্ত। তবে এটি কখন উত্তাল হবে, বলা যায় না। গত রাতে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। ফরাসি এনজিও ‘মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের (এমএসফ)’ ১৪তম চিকিৎসক নিহত হওয়ার খবরে মন ভেঙে গিয়েছিল। দেখা যাক, ফ্রান্স এবার কী করে। এখন পর্যন্ত তারা কেবল কথা বলেছে, কাজ কিছুই করেনি। আমরা এখন সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আলাদা। এটাই ছিল পরিকল্পনা ও কৌশল। ওইসব নৌকা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। আমাদের সঙ্গে থাকা ৮টি ছোট নৌকা ও আমাদের বড় জাহাজ– এই ৯টিই এখন টিকে আছে। বাকি নৌকাগুলো একটু আগে ছেড়েছে, তবে আজ আমরা তাদের ছাড়িয়ে যাব বলে আশা করছি। আমরা তখন গাজাগামী বহরের নেতৃত্বে থাকব, যা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু আমরা শুরু থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। এই জাহাজে মোট ৯৬ জন আছেন। তাদের মধ্যে ৮২ জনই সাংবাদিক, চিকিৎসক ও সংগঠক। এর বাইরে রয়েছেন জাহাজের ক্রুরা। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া নয়, যদিও কিছু জরুরি জিনিসপত্র আমাদের সঙ্গে আছে, যাতে গাজার ভাইবোনদের ওপর আমরা বোঝা না হয়ে যাই। বরং আমরা এসেছি অবরোধ ভাঙতে। আমরা প্রতিবাদ জানাতে এসেছি সাংবাদিক, চিকিৎসক ও সাধারণ নারী-পুরুষ, শিশুকে হত্যা করার বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম মুখ বন্ধ করে আছে। আমরা এসেছি এই মিডিয়া অবরোধও ভাঙতে। আপনাদের ভালোবাসা ও সমর্থন আমাদের শক্তি দেয়। আমরাই জয়ী হবো। ফিলিস্তিন একদিন মুক্ত হবেই!

দুপুর
গতকাল সমুদ্র ছিল উত্তাল, আমিসহ অনেকেই সি-সিকনেসে ভুগছি। আমি একবার পড়ে গিয়েছিলাম। আমার চিকিৎসা করেছেন অসাধারণ চিকিৎসক ডা. মুতাজ জাদান। তিনি ট্রমা ও অর্থোপেডিক সার্জন, স্পাইন সার্জারিতে বিশেষজ্ঞ। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত জর্ডানীয়, বর্তমানে আইরিশ নাগরিক। তিনি আমাকে এমনভাবে যত্ন নিয়েছেন যে নিজেকে রীতিমতো রাজউত্তরাধিকার মনে হয়েছে! আজ আমি ভালো আছি। তবে সবাই যখন খোঁজ নিচ্ছে, তখন ভাবছি সুযোগটা আরও একটু কাজে লাগাই!

প্রতিদিন সকালে সাধারণত নিচের ডেকে আমাদের ব্রিফিং হয়, কিন্তু আজকে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে ব্রিফিং হচ্ছে ক্যাফেটেরিয়াতে। এই জাহাজে আর কোনো বাংলাদেশি নেই, তাই আমি যোগ দিয়েছি মালয়েশিয়ান অ্যাফিনিটি গ্রুপে। সেখানে এমিলি উইলডার আর আমি একমাত্র অ-মালয়েশিয়ান। থাউজ্যান্ড ম্যাডলিনস জাহাজগুলো দিগন্তে দেখা যাচ্ছে। অনেক ছোট ছোট বিন্দুর মতো, কিন্তু আমাদের জন্য খুবই রোমাঞ্চকর দৃশ্য।

প্রমাণ হয়েছে, কীভাবে বাংলাদেশিরা ফ্লোটিলার প্রতি ভালোবাসা দেখাচ্ছে। আগে আমার ফলোয়ার ছিল দুই লাখ ৩০ হাজার। কিন্তু গত কিছুদিনে ফলোয়ার সংখ্যা বেড়েছে বিদ্যুৎ গতিতে। এখন তা দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। মানুষের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা অভূতপূর্ব। অনেক দেশের নেতারা গণহত্যার সহযোগী হলেও তাদের সাধারণ মানুষ স্পষ্টতই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। জনগণের আদালতে সে দেশের নেতারা ইতোমধ্যে অভিযুক্ত। তাদের শাস্তি কার্যকরের অপেক্ষায়।

এসব গণহত্যাকারী নেতাদের প্রতি বার্তা হলো, তোমাদের জনগণ, তোমাদের শিশুরা এবং তোমাদের সন্তানদের শিশুরা তোমাদের কবরের ওপর থুতু ফেলবে।

রাত
গাজার এক সাংবাদিকের সঙ্গে অনলাইনে সাক্ষাৎকার শেষ করলাম। দুঃস্বপ্নের মতো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। কেবল হামলা ও গোলাগুলি মুখে থাকা নয়, সামগ্রিক পরিস্থিতি ভয়াবহ। তবুও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি আমাদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন– অবিশ্বাস্য সাহসের কাজ। সকল শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে অনুরোধ, ব্যক্তিগত আপডেট চাইবেন না। আমি জানি, আপনারা ভালোবাসা থেকেই জানতে চান। কিন্তু এই মুহূর্তে তা সম্ভব না। সাংবাদিকদের কাছেও অনুরোধ, এক্সক্লুসিভ কন্টেন্ট চাইবেন না। আমরা সবাই এক্সক্লুসিভ চাই, কিন্তু দয়া করে বুঝুন, আমরা কী পরিস্থিতিতে আছি। আমি যতটুকু পারি, দৃক-এ কনটেন্ট পাঠাব। ওদের সঙ্গেই যোগাযোগ করুন। সবাইকে ধন্যবাদ। দুঃখিত, ব্যক্তিগতভাবে উত্তর দিতে পারছি না।

৪ অক্টোবর, ২০২৫
‘থাউজ্যান্ড ম্যাডলিনস’ বা বিভিন্ন দেশের ‘হাজার জাহাজ’ নিয়ে গাজায় যাত্রা এক চমৎকার আইডিয়া। যখন বিশ্বনেতারা গাজার গণহত্যা থামাতে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল এবং ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ করছিল তখন সাধারণ মানুষ নিজেরাই এগিয়ে এসেছে। বস্তুত হাজার জাহাজের ধারণাটি প্রতীকী। কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে সমুদ্রপথে সবচেয়ে বড় সম্মিলিত উদ্যোগ। এই বহরে অংশগ্রহণকারী সবচেয়ে বড় জাহাজ হলো কনশানস, যেটি সবার শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ যাত্রা শুরু করে ইতালির ওতরান্তো থেকে। এর আগেই সুমুদ ফ্লোটিলার কিছু জাহাজে ২ অক্টোবর বাধা দেয় ইসরায়েলি বাহিনী আইডিএফ। একটি জাহাজ শুরুতে ধরা না পড়লেও পরে ধরা পড়ে। তবে কনশেনস ছাড়ার আগে ৮টি জাহাজ রওনা দিয়েছিল। আরও দুটি জাহাজ রয়েছে ফ্লোটিং ফ্রিডম কোয়লিশনের; তাদের অবস্থা জানা যায়নি। কনশেনস যেহেতু দ্রুতগামী, তাই এটি মাঝ সমুদ্রে অন্যান্য জাহাজের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আমরা তখন তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাই। তবে এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একসঙ্গে গাজার দিকে এগোব। দুই দিক থেকেই সংহতির যে দৃশ্য আমরা দেখছি, তা অভূতপূর্ব। এটাই জনগণের শক্তি। ইসরায়েল যাই করুক, এই মানবিক স্রোতকে থামানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরা যারা কনশেনস জাহাজে আছি, তারা অবরোধ ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদি আমাদের থামানো হয়, তবে আরও অনেকে আসবে। কোনো অত্যাচারী কখনও জনগণের শক্তির বিরুদ্ধে টিকতে পারেনি। ইসরায়েলও পারবে না। ফিলিস্তিন অবশ্যই মুক্ত হবে।

হ্যাঁ। ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ এখনই। সবাই যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে এগিয়ে আসুন গাজার ভাইবোনদের জন্য।

৫ অক্টোবর ২০২৫, সকাল
শান্ত সমুদ্র আর দারুণ রোদের আলো। গত রাতটা আমি খোলা ডেকে ঘুমিয়েছি। আজই গাজায় পৌঁছানোর কথা ছিল, কিন্তু ছোট নৌকাগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে গতি কমিয়ে দেওয়ায় এখন আরও সময় লাগবে। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গার মধ্যে আছি; আমাদের কোথায় বা কখন আটকানো হতে পারে, তা বলা কঠিন।

দুপুর
অনেকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনি ঠিক কোথায় আছেন?’ ‘গাজায় পৌঁছাতে কত সময় লাগবে’? প্রথম প্রশ্নের উত্তর জানার সবচেয়ে ভালো উপায়, ট্র্যাকার ব্যবহার করে আমাদের যাত্রাপথ অনুসরণ করা। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) আমাদের ব্যাপারে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার ওপর। অতীতের ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে, তারা আমাদের যেতে দেবে– এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা আমাদের আটক করবে। এরপর আমাদের ফেরত অথবা কারাগারে পাঠাতে পারে। কখন, কোথায় এটা ঘটতে পারে, তা আগে থেকে বোঝা অসম্ভব। এটা আমাদের হাতে নেই। এ ক্ষেত্রে আপনাদের সহায়তা প্রয়োজন। যদি আপনারা এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যা আমাদের গাজায় পৌঁছানোর জন্য চাপ তৈরি করে, তবে সেটা হবে সবচেয়ে ভালো। একমাত্র উপায় হলো, ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর ওপর সাধারণ মানুষের ব্যাপক চাপ প্রয়োগ। কাজেই এবার আপনাদের সুযোগ; পদক্ষেপ নিন। এক হোন, প্রতিরোধ করুন। এটা অধিকার আর ন্যায়বিচারের প্রচারণা। আমাদের একসঙ্গে এটা করতে হবে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে আজ সকালে শুভেচ্ছা বার্তা পেয়ে আমি আনন্দিত। দেশের মানুষ, বন্ধু এবং সারাবিশ্বের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সংহতি ও সমর্থনের বার্তা পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে।

রাত
আজ রাতে চাঁদের আলোয় ঝলমলে সমুদ্র। আশা করি, সমুদ্র শান্তই থাকবে। আজকের দিনটা ছিল একেবারে ব্যস্ততম। গুচ্ছ গুচ্ছ মিডিয়া সাক্ষাৎকার। চাঁদের আলোয় রাতে ইসরায়েলি হামলার প্রস্তুতিমূলক মহড়া, তারপর রান্নাঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আমি আর ভেরোনিকা একসঙ্গে গেয়ে উঠলাম– ‘মাই বনি লাইস ওভার দ্য ওশান’।

৬ অক্টোবর ২০২৫
আমরা ছোট ছোট ও ধীর গতিসম্পন্ন নৌযানগুলোর জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ আমরা তাদের পেছনে রেখে যেতে চাই না। আজ সকালে তাদের কনশেনস জাহাজের পাশে ভিড়তে দেখে ভালো লাগছে। সকালে সূর্যোদয়ের আগের ছবি তুলেছিলাম। সেখানে ‘থাউজ্যান্ড ম্যাডলিনস’ নৌযানগুলো দিগন্ত থেকে ফ্রেমে উঁকি দিচ্ছিল।

৭ অক্টোবর ২০২৫
আমরা এখন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের অংশ কনশেনস জাহাজে আছি। এর আগে সুমুদ ফ্লোটিলা ফিলিস্তিনের অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করেছিল। তারাও এফএফসির অংশ ছিল। তার সব জাহাজই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। তবুও আমরা আমাদের যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছি। কনশেনস জাহাজের যাত্রীরা মূলত সাংবাদিক ও চিকিৎসক, দুটি পেশাজীবী গোষ্ঠী, যাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েল ইতিহাসে অভূতপূর্ব সংখ্যায় হত্যা করেছে। এ দুই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই যাত্রা একটি প্রতিবাদ। ইসরায়েল সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের নিশানা করে যে হামলা চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ও গাজার বেআইনি অবরোধে চ্যালেঞ্জ করে এ যাত্রা আমাদের প্রতিবাদ।

আমরা কিছুটা পিছিয়ে। কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি থাউজ্যান্ড ম্যাডলিনস নামের ছোট ও ধীরগতির নৌযানগুলোকে পেছনে ফেলে যাব না; এগুলোও এফএফসির অংশ। তবে আমরা আগের সুমুদ ফ্লোটিলার তুলনায় অনেক দ্রুত অগ্রসর হয়েছি, যা তীব্র বাতাস ও বড় একটি ঝড়ের কারণে কিছু সময়ের জন্য থেমে গিয়েছিল। এখন ধীরগতির নৌকাগুলোও আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং আমরা বর্তমানে কথিত ‘রেড জোন’ থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে, যে অঞ্চলে আইডিএফ ইতোপূর্বে বেআইনিভাবে অন্যান্য ফ্লোটিলাকে আটক করেছে।

৮ অক্টোবর ২০২৫
আমরা সমুদ্রে খুব একটা পাখি দেখি না। তবে আজ একঝাঁক পাখি দেখেছি, যেগুলো অনেকটা চড়ুই পাখির মতো। তারা ওড়াউড়ি ও পানিতে ডোবাডুবি করছিল। আমি তাদের ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। আমি যখন কেরানীগঞ্জ কারাগারে ছিলাম তখন প্রায়ই চড়ুই পাখির খাওয়াতাম। আমি কারাগারকে মিস না করলেও চড়ুইগুলোকে মিস করি। আমি এখন দেশ থেকে হাজারো মাইল দূরে। সামনে অনিশ্চিত সময়। এখানকার নতুন বন্ধুদের নিয়েই আমার সময় কাটে।

আটকের আগে শেষ পোস্ট
আমি বাংলাদেশের ফটোগ্রাফার ও লেখক শহিদুল আলম। আপনি যদি এই ভিডিও দেখে থাকেন, তবে জেনে থাকবেন, সমুদ্রে আমাদের গতিরোধ করা হয়েছে এবং আমি দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর অপহরণের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ক্ষমতার বলে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। সকল কমরেড ও বন্ধুদের প্রতি আমার আবেদন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন।