কালো জাদুর অভিযোগে মবের তাণ্ডব, এক পরিবারে পাঁচজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা

গত ৬ জুলাই রোববার ভারতের বিহারের একটি আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দাদের ঘুম ভেঙে যায় রাতের নিস্তব্ধতা চিরে চেঁচামেচি আর অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণে। বিহার রাজ্যের পুর্নিয়া জেলার ছোট্ট গ্রাম তেতগামা। সেখানকার বাঁশ, কাদা ও ভুট্টার খড় দিয়ে তৈরি বাড়িগুলো দিনের আলোয় নিরীহ দেখা গেলেও রাতের আঁধারে ঠিকই রহস্যময় হয়ে ওঠে।

সেদিন রাতে যা ঘটেছিল তা কোনো লোককথা নয়, বরং বর্বর বাস্তবতা। সেদিন একই পরিবারের পাঁচজনকে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী রশিতে বেঁধে টেনে নিয়ে যায় পুকুরপাড়ে। এরপর পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তাঁদের শরীরে। কারও চিৎকার, কারও আর্তনাদ, কারও হাতজোড় করা—কিছুই কাজ করেনি।

তেতগামা এখন প্রায় জনশূন্য। অধিকাংশ মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। কেবল নিহত বৃদ্ধা কাতো ওরাঁওয়ের চার ছেলের পরিবার আছে সেখানে। বাকিদের বাড়িগুলো তালাবদ্ধ, কিছু যেন তাড়াহুড়ো করে ফেলে যাওয়া। নিস্তব্ধতা এখন এখানে সবচেয়ে বড় শব্দ।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মনীষা দেবী (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমরা দাঁড়িয়ে থেকে অসহায়ের মতো দেখছিলাম—ওই মানুষগুলো মরিয়া হয়ে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিল।’ তিনি জানান, এখনো চোখে লেগে আছে সেই দৃশ্য, এখনো কানে বাজে তাদের আর্তনাদ।

সেদিন রাত ১০টার দিকে তেতগামার বাসিন্দা বাবুলাল ওরাঁওয়ের ঘরের সামনে জড়ো হয় একদল উন্মত্ত জনতা। বাবুলাল ওরাঁও, তাঁর স্ত্রী সীতা দেবী, ছেলে মঞ্জিত ও তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী রানি দেবী ও বাবুলালের ৭১ বছর বয়সী মা কাতো ওরাঁওয়ের প্রাণ সে রাতে নিভে যায়। বেঁচে যায় কেবল বাবুলালের কনিষ্ঠ সন্তান—এক কিশোর। যেকোনোভাবে পালিয়ে গিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ে, আর সেখান থেকেই দেখে তার পরিবারকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে।

ঘটনার সূত্রপাত আরও ১০ দিন আগে, যখন রামদেব ওরাঁওয়ের ছেলে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, রামদেব বিশ্বাস করতে থাকেন, তাঁর ছেলের মৃত্যু কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এটা নাকি ‘ডাইনীবিদ্যা’ বা ‘কালো জাদু’। আর দায়ী কাতো ওরাঁও ও তাঁর পুত্রবধূ সীতা।

ঘটনার দিন রাতে অসুস্থ ভাতিজাকে নিয়ে রামদেব হাজির হন কাতোদের বাড়িতে। সঙ্গে গ্রামের পরিচিত ওঝা, যিনি ঝাড়ফুঁক শুরু করেন, মন্ত্র পড়েন এবং শেষে ঘোষণা দেন—কাতো ও সীতা নাকি ডাইনি। উপস্থিত জনতা মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মনীষা দেবী বলেন, ‘কাতোকে টেনে আনা হয় ঘর থেকে। বলা হয়, আধঘণ্টার মধ্যে ছেলেটিকে সুস্থ না করলে তাঁর ভয়াবহ পরিণতি হবে। সীতা তখন ছিলেন তাঁর মায়ের বাড়ি। তাঁকে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠানো হয়।’

সীতা ফিরে আসার পরপরই শুরু হয় নৃশংস গণপিটুনি। এ সময় বাবুলাল ও ছেলে মঞ্জিত বাধা দিতে গেলে জনতা তাঁদেরও মারধর করে। রানি দেবী স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হন।

পুলিশের এফআইআরে বলা হয়েছে, ‘জনতা লাঠি, রড ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে আসে। পাঁচজনকে রশি দিয়ে বেঁধে গ্রামের পুকুরের দিকে টেনে নিয়ে যায়, পথেই চলতে থাকে মারধর। তাঁরা তখন অর্ধমৃত। এরপর তাঁদের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।’ ঘটনার পর তাঁদের দেহ বস্তায় ভরে ট্রাক্টরে করে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে স্থানীয় পুকুর থেকে উদ্ধার হয় পাঁচটি পোড়া দেহ।

তেতগামা গ্রামটি মুফাসসিল থানার মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে। অথচ পুলিশ ঘটনার খবর জানতে পারে ঘটনার ১১ ঘণ্টা পরে। জেলা প্রশাসক অনশূল কুমার বলেন, ‘এটা আমাদের স্পষ্ট ব্যর্থতা। কোথাও না কোথাও ভুল হয়েছে। তবে পুরো সম্প্রদায়ই এতে জড়িত থাকায় খবর পৌঁছাতে দেরি হয়।’

পুলিশ তদন্তে জানা যায়, পুরো গ্রাম থেকে ২৩ জনের নাম পাওয়া গেছে, সঙ্গে ১৫০ থেকে ২০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি, যারা ওই রাতের উন্মত্ত মব বা জনতার অংশ ছিলেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গণপিটুনি, বেআইনি জমায়েত, ধারালো অস্ত্রে আঘাত, অপহরণ, হত্যার আলামত লোপাট—এই সব ধারায় মামলা করা হয়েছে। চারজনকে, যার মধ্যে ওঝাও আছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিরা পলাতক।

নিহতদের বেঁচে থাকা সন্তানেরা এখন অন্য গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের খাবার ও প্রাথমিক সহায়তা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাবুলালের কিশোর ছেলেটি বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে নিরাপদ স্থানে আছে এবং তাকে মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

প্রশাসনের ভাষায়, এই অঞ্চলে এর আগে জাদুবিদ্যার অভিযোগে কোনো হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। এটা ছিল সম্পূর্ণ কুসংস্কারপ্রসূত এক উন্মত্ততা। তবে স্থানীয় সমাজকর্মী মীরা দেবী বলেন, ‘এই আদিবাসী গ্রামগুলোতে মানুষের ওঝাদের ওপর প্রবল বিশ্বাস। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের চেয়ে বেশি ভরসা তারা রাখে ঝাড়ফুঁকে।’

গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সন্তোষ সিং বলেন, ‘শিশুরা স্কুলে যায় না। তারা মা-বাবার সঙ্গে পাশের ইটভাটায় কাজ করে।’ এক স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘শুধু তিনজন ছাত্রের নাম রয়েছে রেজিস্ট্রারে, কিন্তু কেউ স্কুলে আসে না।’

তেতগামা গ্রামের মাঠে পুড়ে যাওয়া ভুট্টার খড়গুলো যেন সাক্ষী হয়ে আছে সেই রাতের। বাবুলালের মাটির ঘরে এখনো সেই খাট, মশারির নিচে অক্ষত চাদর, যেন কেউ ফিরবে বলে রেখে গেছে। মনীষা দেবী কাঁপা গলায় বলেন, ‘আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাতো বারবার বলছিলেন, আমাদের দোষ নেই। কিন্তু কেউ শুনল না।’

এক প্রতিবেশী বলেন, ‘ওই রাত আমাদের চোখে কেবল মৃত্যু দেখিয়েছে। ঘুম আসে না। মনে হয়, এখনো কেউ বাইরে ডাকছে…আগুনের লকলকে শিখা যেন চোখে লেগে আছে।’