জ্বর আতঙ্কে জনজীবন, অবহেলা না করার পরামর্শ চিকিৎসকদের

দুই দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন বেসরকারি চাকরিজীবী শাকিরুল। শরীরব্যথাও রয়েছে। এমন জ্বর সাধারণত ‘মৌসুমি ফ্লু’ ভেবে অবহেলা করলেও এবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি। কারণ, সম্প্রতি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও করোনাভাইরাস—এই তিন ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। ফলে সংক্রমণের আশঙ্কায় নিজের পরিবারের সদস্যদের দিকেও চোখে চোখে রাখছিলেন। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার জ্বর সাধারণ ভাইরাসজনিত।

তবে শুধু শাকিরুল নন, এখন জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে ভাইরাসঘটিত নানা রোগ। টাইফয়েড, মৌসুমি ফ্লু কিংবা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা—এদের উপসর্গ একে অপরের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ এলেও উপসর্গ থেকেই যাচ্ছে।

হাসপাতাল ঘুরে জানা গেছে, জ্বর নিয়ে রোগী আসার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। সরকারি ১৮টি হাসপাতালে বর্তমানে ২৪২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ঢাকার ৫৯টি বেসরকারি হাসপাতালে আরও ৬৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। সেখানে সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ৩ হাজার ৮৬৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন, যা মোট আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক। এছাড়াও চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩১২ জন, ঢাকার বাইরে ৭৯৬ জন, খুলনায় ২৫৯ জন, রাজশাহীতে ২৬১ জন, ময়মনসিংহে ১১৩ জন, রংপুরে ২৬ জন এবং সিলেটে ২১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

আর ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬৮২ জন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ হাজার ২০৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। মৃত্যুর দিক থেকেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বরিশালে ৮ জন, চট্টগ্রামে ৪ জন, খুলনায় ২ জন এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহে ১ জন করে মারা গেছেন।

চিকুনগুনিয়া নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি’র তথ্যে দেখা গেছে, চলতি জুন মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে তাদের ল্যাবে পরীক্ষা করাতে আসা ১৭১ জনের মধ্যে ১৪০ জনের দেহে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর বলছে, তাদের পরীক্ষায় ৩৩৭টি নমুনার মধ্যে ১৫৩ জনের দেহে ভাইরাস পাওয়া গেছে, শনাক্তের হার ৪৫ শতাংশ। তবে প্রকৃত রোগী সংখ্যার সঠিক চিত্র সরকারের কাছে নেই, কারণ সমন্বিত কোনও তথ্যভান্ডার এখনও তৈরি হয়নি।

মঙ্গলবার (২৪ জুন) বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত একটি ‘কনটিনিউয়িং মেডিক্যাল এডুকেশন (সিএমই)’ সেশনে দেশের ভাইরাসজনিত জ্বরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান উপস্থাপনায় জানান, বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং কোভিড-১৯ এর নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে।

তিনি বলেন, ‘জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালকে ভাইরাসজনিত জ্বরের জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল ধরা হয়। এই তিন ভাইরাস মিলে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে। চিকিৎসা খাতের অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা না বাড়ালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।’

২০১৭ সালের পর ফের দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে জানিয়ে ডা. আবেদ বলেন, এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার কম হলেও রোগের পরে দীর্ঘমেয়াদি উপসর্গ—যেমন গিটে ব্যথা, র‌্যাশ ও দুর্বলতা—রোগীর দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই এটি সাধারণ জ্বর ভেবে অবহেলা করা উচিত নয়।

ডেঙ্গু সংক্রমণের বিষয়ে তিনি জানান, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বরিশাল ও বরগুনা জেলায়। চলতি জুন মাসে ১ হাজার ৮৭৭ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শুধু এ সপ্তাহেই বরিশালে ৫ জন এবং ঢাকায় ২ জন মারা গেছেন। বর্তমানে ডেঙ্গুর মধ্যে ডেন-১, ডেন-২ এবং ডেন-৩ সেরোটাইপ সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ।

এসময় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের বিষয়েও কথা বলেন তিনি। বলেন, তিন ডোজ টিকা নেওয়ারা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হলেও নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ফ্লুরোনা’ (ফ্লু ও করোনা একসঙ্গে সংক্রমণ) রোগীদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, স্থুলতা, ক্যান্সার বা কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, বর্তমানে করোনায় জ্বরের সঙ্গে শরীরব্যথা, মাথাব্যথার উপসর্গও বাড়ছে, ফলে পরীক্ষার আগে এটি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার পার্থক্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়ায় হাড়ের জয়েন্ট ও মাংসপেশিতে ব্যথা বেশি হয় এবং র‌্যাশ দেখা দেয় দ্রুত। ডেঙ্গুতে চোখের পেছনে ব্যথা, পাতলা পায়খানা ও পেটব্যথা বেশি লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ ভাইরাস জ্বরে সর্দি-কাশির সঙ্গে হালকা গায়ে ব্যথা থাকে এবং তা চার দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে এর চেয়ে বেশি স্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগকে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি যেসব এলাকায় রোগী বেশি, সেখানে দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে, না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে।’

অন্য এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে একসঙ্গে একাধিক ভাইরাস বাড়ছে—করোনা, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া ইত্যাদি। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে যে কোনটা কোন রোগ। এজন্য ভয়ের কিছু নেই, সচেতনতা জরুরি। লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষা ও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।’

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *