ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে বিলম্ব ঘটানোর উদ্দেশ্যে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গত শুক্রবার ভোরে চালানো ওই হামলায় পরমাণু স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা, শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং পরমাণুবিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। তবে কেবল পরমাণু কর্মসূচি নয়—হামলার ধরন, লক্ষ্যবস্তু এবং ইসরায়েলি নেতাদের বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে আরও বড় উদ্দেশ্যের। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, ইসরায়েলের এই আক্রমণের মূল লক্ষ্য হতে পারে ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পতন।
হামলার পর ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির জ্যেষ্ঠ গবেষক ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা মাইকেল সিং বলেন, “আংশিকভাবে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের আশায় ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে—এমনটি ধরে নেওয়া যেতে পারে।” তার মতে, সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি আঘাত না করে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট।
শুক্রবারের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের জনগণের উদ্দেশে ভিডিও বার্তায় বলেন, “ইসলামি শাসনব্যবস্থার নামে আপনাদের প্রায় ৫০ বছর ধরে দমন করা হচ্ছে। এখন সেই শাসনই আমাদের ধ্বংসের হুমকি দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের হামলার লক্ষ্য শুধু সামরিক নয়, আপনাদের স্বাধীনতার পথও আমরা খুলে দিচ্ছি।”
নেতানিয়াহু দাবি করেন, “এই শাসকগোষ্ঠী কীভাবে আঘাত করা হয়েছে, তা বুঝতেই পারেনি। এখন তারা সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এটাই আপনাদের সুযোগ—উঠে দাঁড়ান, কথা বলুন, নিজেরা নিজেদের ভাগ্য গড়ুন।”
তবে এত বড় হামলার পরও ইরানে সরকারবিরোধী জনমত গড়ে উঠবে কিনা, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা দ্বিধায় রয়েছেন। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে দেশটির জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী এখনো শাসকদের প্রতি অনুগত।
মাইকেল সিং বলেন, “ইরানে জনবিক্ষোভ গড়ে তোলার জন্য কী ধরনের পরিস্থিতি দরকার, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।”
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের এই হামলা একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হতে পারে। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে দেশটিকে পরমাণু বোমা তৈরির পথ থেকে বিরত রাখার লক্ষ্য রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রথম দফার হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বড় একটি অংশ ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। ইসরায়েলি দূতাবাস জানিয়েছে, “ইসরায়েল একটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি দেশের জনগণ নিজেদের সরকার নির্বাচনের অধিকার রাখে।”
এদিকে, ইরান দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরান সম্প্রতি বৈশ্বিক পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং দেশজুড়ে উদ্ধারকাজ অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েলের উপকূলীয় শহর ব্যাট ইয়ামে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া গেছে।
মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ইরান সরকার পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার ইসরায়েলের হামলাকে সমর্থন করেছে এবং পাল্টা হামলা ঠেকাতে দেশটিকে সহায়তা দিচ্ছে।
রয়টার্সের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে হোয়াইট হাউস ও জাতিসংঘে ইরানের মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষ এখন আর শুধু প্রতিরক্ষা বা পরমাণু নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, বরং দুই দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক চেহারা নিয়েও দ্বন্দ্বের দিকেই এগোচ্ছে।
Leave a Reply